মুক্তিযুদ্ধ ও পূর্বাপর ঘটনা নিয়ে একান্ত সাক্ষাৎকারে মুক্তিযোদ্ধা ডা. হামিদুল হক

প্রকাশ:

Share post:

মুক্তিযুদ্ধের সময়ের একদিনের ঘটনা। তখন দিন-তারিখ মনে রাখাও অসম্ভব ব্যাপার ছিল বীর মুক্তিযােদ্ধাদের। রাজারহাটের সিংগেরডাবড়ি রেলস্টেশনের কাছে। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর কিছু সেনা স্থানীয় বাজারে চালাচ্ছিল লুটতরাজ। ঠিক সেই সময় সেখানে হাজির হয় অকুতােভয় এক কিশাের মুক্তিযােদ্ধা। একদম সামনাসামনি পড়ে যান তিনি হানাদার পাকসেনাদের। তার দিকে অস্ত্র তাক করছে পাকিস্তানি হানাদার। যতই সাহসী বীর হােক না কেন মানুষ তাে! জল্লাদের অস্ত্র বুকের দিকে তাক করা হয়েছে বুঝতে পারেন কিশাের বীর মুক্তিযােদ্ধা হামিদুল। একটা ঢােক গেলেন। মৃত্যু একদম কাছাকাছি স্পষ্ট বুঝতে পারেন। চোখের পলকে ভেসে ওঠে প্রিয়জনদের মুখ। মনের মধ্যে ক্রোধ জাগে পাকিস্তানি হায়েনাদের থাবা থেকে মুক্ত স্বাধীন বাংলাদেশ দেখে যেতে পারবেন না! কী যেন অকস্মাৎ হয়ে যায়। শরীরের পেছনে লুকানাে আগ্নেয়াস্ত্র বের করে ঠা ঠা ঠা। ফায়ার শুরু করে একদিকে ঝাঁপিয়ে পড়েন গর্তের মধ্যে কাভার নিতে। এর মধ্যে আরাে কয়েকজন সহযােগী মুক্তিযােদ্ধা তাঁর সাহায্যে এগিয়ে আসেন। দুই পক্ষের সামনাসামনি গােলাগুলি চলতে থাকে। তারপর আত্মরক্ষার্থে ক্রোল করে কীভাবে কীভাবে যেন মুক্তিযােদ্ধারা নিজেদের রক্ষা করেন। একদম মৃত্যুর মুখ থেকে প্রাণে বেঁচে যান বীর মুক্তিযােদ্ধা হামিদুল হক খন্দকার। বরেণ্য অর্থোপেডিক্স চিকিৎসক, রংপুরের অর্থোপেডিক্স চিকিৎসার পুরােধা, বীর মুক্তিযােদ্ধা, সংগঠক ও সমাজসেবক অধ্যাপক ডা. হামিদুল হক খন্দকার একজন আলােকিত গুণীজন। ১৯৫৫ সালের ১২ মার্চ কুড়িগ্রাম জেলার বর্তমান ফুলবাড়ি উপজেলায় জন্ম জনাব হামিদুল হক খন্দকারের। পিতা ডাক্তার নজির হােসেন খন্দকার ও মাতা আফরােজা বেগম। বাবা-মা দুজনেই পৃথিবীর মায়া ছেড়ে চলে গেছেন। ফুলবাড়ি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাট চুকিয়ে ভর্তি হন ফুলবাড়ি জসিমিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ে। ১৯৭১-এর ব্যাচের মেধাবী এই শিক্ষার্থী ১৯৭২-এ এসএসসি পাস করে ভর্তি হন কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজে। এখান থেকে ১৯৭৪ সালে এইচএসসি সম্পন্ন করে অংশ নেন এমবিবিএস ভর্তি পরীক্ষায়। ভর্তি যুদ্ধে উত্তীর্ণ হয়ে রংপুর মেডিকেল কলেজের পঞ্চম ব্যাচে ভর্তির সুযােগ পান। ১৯৮২ সালে এমবিবিএস সম্পন্ন করেন যােগ্যতার সাথে এবং ওই বছরেই রংপুর মেডিকেল কলেজ থেকে কর্মজীবন শুরু করেন। বিসিএস চিকিৎসক হিসেবে ১৯৮৩-তে প্রথম পােস্টিং পান নাগেশ্বরী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। ১৯৮৫-তে রংপুর। মেডিকেল কলেজে আসেন সহকারী রেজিস্ট্রার হিসেবে অর্থপেডিক্স বিভাগে। ১৯৮৯ সালে উচ্চশিক্ষার জন্য পােস্টিং নিয়ে জাতীয় পঙ্গু হাসপাতাল (নিটোর) -এ যােগদান করেন। ১৯৯৭ পর্যন্ত নিটোরে থাকেন।এখানে তিনি অর্থপেডিক্স চিকিৎসায় উচ্চতর কোর্স এমএস সম্পন্ন করেন। এর বাইরেও তিনি অপারেশনের বিভিন্ন কৌশল আত্মস্থ করার জন্য অগ্রজ শিক্ষকদের করতেন সহযােগিতা তিনি দেশবরেণ্য অনেক গুণী অর্থপেডিক্স বিশেষজ্ঞের কাছে এ-সংক্রান্ত অনেক জ্ঞান অর্জনের সুযােগ পেয়েছেন। এরপর ফিরে আসেন প্রিয় রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে। ২০০৫ সালে এখানে সহযােগী অধ্যাপক হিসেবে পদোন্নতি লাভ করেন। তাঁর পূর্বতন তিনজন সহকারী অধ্যাপকের সাথে রংপুর মেডিকেলে অর্থপেডিক্স চিকিৎসার আধুনিকায়নের কাজ তিনি শুরু করেছিলেন।

আরও পড়ুন:  ভিসিময় বিশ্ববিদ্যালয়!

পরবর্তীতে জনাব হামিদুল হক খন্দকারের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় এই বিভাগে আধুনিক চিকিৎসা বিশেষ করে জটিল ও কঠিন হাড়ভাঙা রােগীর অপারেশনের ব্যাপ্তি লাভ করে। এই বিভাগের জুনিয়র শিক্ষক, চিকিৎসক ও ছাত্র-ছাত্রীরা তাঁর সাহচর্যে লাভ করেন। অর্থপেডিক্স চিকিৎসার আধুনিক কলাকৌশলের শিক্ষা। একসময় এই অঞ্চলের মানুষকে এ-সংক্রান্ত অপারেশন কিংবা চিকিৎসার প্রয়ােজনে যেতে হতাে রাজধানীতে। ২০০৮ সালে অধ্যাপক হিসেবে পদোন্নতি লাভ করলেন তিনি। এরপর দিনাজপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অধ্যক্ষ হিসেবে যােগদান করেন। তার সময়ে দিনাজপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ ঘটে। নিরসন হয় দীর্ঘদিনের জনবল সংকটের। ২০১৩-এর ডিসেম্বরে তিনি জাতীয় পঙ্গু হাসপাতাল বা ২০১৩-এর ডিসেম্বরে তিনি জাতীয় পঙ্গু হাসপাতাল বা নিটোরের পরিচালক হিসেবে যােগদান করেন। এই গুরুত্বপূর্ণ পদে এই অঞ্চলের আর কেউ দায়িত্বপ্রাপ্ত হননি। ২০১৫ সালে এখান থেকে চাকরি জীবনের সমাপ্তি ঘটিয়ে অবসর গ্রহণ করেন। বর্তমানে তিনি রংপুরে প্র্যাকটিস করছেন। চিকিৎসক হিসেবে তিনি অপারেশনের ক্ষেত্রে নতুন কৌশল নিয়ে ভাবতেন। এখানে উল্লেখ্য যে, অর্থপেডিক্স অপারেশনে ভাঙার ধরনের ভিন্নতার জন্য তাৎক্ষণিকভাবে কিছু কৌশল অভিজ্ঞ চিকিৎসকরা নিয়ে থাকেন। তিনি নতুন নতুন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক তৈরিতে তাঁর দীর্ঘ ও বাস্তব অভিজ্ঞতা উজাড় করে দিতেন। এই অঙ্গনে তিনি একজন বটবৃক্ষ হিসেবে পরিচিত। তিনি দেশের একজন প্রখ্যাত অর্থপেডিক্স চিকিৎসক ও সার্জন। দেশজুড়ে রয়েছে তার অসংখ্য গুণমুগ্ধ চিকিৎসক ও রােগী।

অধ্যাপক ডা. হামিদুল হক খন্দকার একজন বিশিষ্ট মুক্তিযােদ্ধা। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি মাত্র দশম শ্রেণিতে পড়াশােনা করতেন। জীবনবাজি রেখে একের পর এক সম্মুখযুদ্ধ এবং গেরিলা যুদ্ধে লড়াই করে গেছেন স্বাধীনতার জন্য। প্রথমে কুড়িগ্রামের ধরলা বেল্টে পাকিস্তানি হানাদারদের বিরুদ্ধে শুরু করেন যুদ্ধ। কিছুদিন ক্যাপ্টেন নওয়াজেশের অধীনে যুদ্ধ করেছিলেন। আরাে উচ্চপ্রশিক্ষণের জন্য ভারতের দার্জিলিংয়ের পাদদেশে মুজিব ক্যাম্পে যান। এখানে ভারতীয় সেনাবাহিনী যুদ্ধের বিভিন্ন অস্ত্র ও কৌশল প্রশিক্ষণ দিত। এখানে বাছাই পর্বে ১০৬ জনের মধ্যে তিনিসহ আরাে ৪১ জন প্রশিক্ষণের জন্য নির্বাচিত হন। সেখানে শেখ কামালের সাথে প্রশিক্ষণের সুযােগ হয়েছিল। অত্যন্ত কঠিন ছিল এই ট্রেনিং। বিভিন্ন অস্ত্র ও আর্টিলারি প্রশিক্ষণ এক মাস সময়ের মধ্যে গ্রহণ করতে হয়। এরপর সরাসরি চলে আসেন বাংলাদেশের অভ্যন্তরে। তাদের ৪২ জনের দলের জন্য অস্ত্র পেয়েছিলেন ২১ টি। এই অর্ধেক অস্ত্র আর বুকভরা সাহস নিয়ে প্রশিক্ষিত পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করেন। কখনাে গেরিলা হামলা আবার কখনাে সম্মুখযুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিলেন। মােগলহাটের এক সম্মুখযুদ্ধে প্রাণ সংশয়ে পড়েছিলেন। মৃত্যুকে দেখেছিলেন আবার একদম চোখের সামনে। তিনদিন না খেয়ে আত্মগােপনে থাকতে হয়েছিল এ সময়। এই অপারেশনে হতাহত হয়েছিল বেশ কিছু মুক্তিযােদ্ধা। ৬ ডিসেম্বর কুড়িগ্রাম বিজয় সম্পন্ন হলে জনাব হামিদুল হকসহ ২৫ জনের একদল বীরযােদ্ধা রংপুরের উদ্দেশে অর্থাৎ মুক্তিযােদ্ধাদের সাহায্য-সহযােগিতা করতে রওনা দেন। তারা তিস্তার পাড় দিয়ে হেঁটে হেঁটে গঙ্গাচড়ার মহিপুর দিয়ে রংপুর। শহরে ঢােকার চেষ্টা করেন। এর মধ্যে ১৬ ডিসেম্বর শহরে ঢােকার আগেই জানতে পারেন রংপুরের বিজয় অর্জনের খবর। পরে জুম্মাপাড়া দিয়ে শহরে ঢুকে বিজয় আনন্দে শরিক হন।

আরও পড়ুন:  গুণীজনদের সাথে সেমিনারে অংশগ্রহণ

জনাব খন্দকার ছাত্রজীবনে ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলেন। পেশাগত জীবনে স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) সাথে যুক্ত ছিলেন। ১৯৯০-এর গণ অভ্যুত্থানে ঢাকায় ছিল তাঁর উল্লেখযােগ্য ভূমিকা। অবসর নেতৃত্ব পরিষদের গ্রহণের দিয়েছিলেন। তখন পর তিনি জাতীয় এই সেখানে আন্দোলনে সংসদ সাধারণ নির্বাচনে শেরে সম্পাদকের কুড়িগ্রাম-বাংলা -২ দায়িত্বে নগর আসনে চিকিৎসক ছিলেন সংসদ। সদস্য পদে নির্বাচন করতে চেয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী সে সুযােগ দিলে তিনি আগামীতে নির্বাচন অংশ নেবেন বলে জানালেন। একজন সংগঠনপ্রিয় মানুষ তিনি। সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের প্রতি রয়েছে তার টান। একসময় শতাব্দীর আহ্বান করেছিলেন। তিনি রংপুর পদাতিকের উপদেষ্টা, রংপুর নাট্যকেন্দ্রের উপদেষ্টা। লায়ন্স ক্লাব অব রংপুরের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। ছিলেন দাতব্য চক্ষু চিকিৎসালয়ের সহ সভাপতি। আছেন রংপুর ডায়াবেটিক হাসপাতালের নির্বাচিত সহ-সভাপতি হিসেবে। তিনি বঙ্গবন্ধু পরিষদ, বঙ্গবন্ধু শিক্ষা ও গবেষণা পরিষদের বিভাগীয় সাধারণ সম্পাদক ও কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিলেন বর্তমানে তিনি এই দুটি সংগঠনের উপদেষ্টা। জাতীয় চার নেতা পরিষদ, রংপুর-এর তিনি একজন উপদেষ্টা। তিনি বাংলাদেশ অর্থপেডিক সােসাইটির ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করেন। বর্তমানে তিনি ন্যাশনাল স্টুডেন্ট অরগানাইজেশন নামের একটি জাতীয় সংগঠন পরিচালনা করছেন। এই সংগঠন মূলত মাদক, দুর্নীতি ও সন্ত্রাসবিরােধী কার্যক্রম ও সচেতনতা সৃষ্টিতে কাজ করে যাচ্ছে। তিনি পেশা জীবনে দেশ বিদেশে অনেক সেমিনার ও সিম্পােজিয়ামে অংশ নিয়েছেন। ঘুরেছেন অনেক দেশ। পেয়েছেন অনেক পুরস্কার ও সম্মাননা। এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযােগ্য আলােকিত বাংলাদেশ সম্মাননা, চিকিৎসা সংক্রান্ত কাজে বিশেষ অবদানের জন্য দিনাজপুরে সম্মাননা ও সংবর্ধনা, বঙ্গবন্ধু শিশুকিশাের পরিষদের সম্মাননা। সহধর্মিণী চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. মকসুদা খাতুন বর্তমানে অবসর গ্রহণ করেছেন। তাঁদের দুই ছেলে। বিশিষ্ট এই চিকিৎসক মানুষের সেবা করার প্রতি জোর গুরুত্বারােপ করে চিকিৎসকদের উদ্দেশে বলেন, মানুষের সেবা করা চিকিৎসকের ধর্ম। একজন অসুস্থ মানুষ সৃষ্টিকর্তার পরে চিকিৎসকের ওপর ভরসা করেন। আস্থা রাখেন। তিনি অসুস্থ মানুষের সেবায় সংশ্লিষ্টদের সচেষ্ট থাকার প্রতি জোর দেন। তিনি মানুষের সেবায় চিকিৎসকদের পাশাপাশি সকলকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান।
তথ্যসূত্রে: আলোর দ্বীপ বই।

spot_img

সংবাদ সারাদেশ

ফিটনেস পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করাসহ গ্রীন ভয়েসের ৭ দাবি

পরিবেশ সুরক্ষায় পুরনো যানবাহনের ব্যবহার বন্ধ করা ও কালো ধোঁয়া নির্গমন ঠেকাতে ফিটনেস পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করাসহ ৭ দফা...

জানাক ও বৈষম্যবিরোধীর নেতৃত্বে আসছে নতুন রাজনৈতিক দল

জাতীয় নাগরিক কমিটি ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলনের নেতাদের নেতৃত্বে আসছে নতুন একটি রাজনৈতিক দল। আগামী ২৬ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদ...

কুয়েট উপাচার্যকে লাঞ্ছিত করার ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় পরিষদের নিন্দা

খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুয়েট) উপাচার্যকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করার ঘটনায় তীব্র প্রতিবাদ ও নিন্দা জানিয়েছেন দেশের পাবলিক...

ইটভাটায় কাজে গিয়ে নিখোঁজ সন্তানকে ফিরে পরিবারের সংবাদ সম্মেলন

মাদারীপুর প্রতিনিধি: গাজীপুরে একটি ইটভাটায় কাজ করতে গিয়ে নিখোঁজ হয় মাদারীপুরের কালকিনি উপজেলার আলীনগর ইউনিয়নের কোলচুরি গ্রামের ১৯...

Discover more from bartabulletin.com

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading