নিজস্ব প্রতিবেদক: বাংলাদেশ বিজ্ঞান একাডেমির আয়োজনে “Understanding molecular plant -microbe interaction for biorational management of plant health ” শিরোনামে একাডেমি লেকচার প্রদান অনুষ্ঠিত হয়েছে।
সোমবার বেলা ১১টায় জুম প্লাটফর্ম এর মাধ্যমে উক্ত একাডেমি লেকচার প্রদান করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্সটিটিউট অব বায়োটেকনোলজি এন্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এর প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক, বাংলাদেশ ও বিশ্ব বিজ্ঞান একাডেমীর ফেলো কৃষি বিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. মো: তোফাজ্জল ইসলাম। বাংলাদেশ বিজ্ঞান একাডেমীর সহ- সভাপতি অধ্যাপক ড. জহুরুল করিম এর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন একাডেমীর সভাপতি ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ইমিরেটাস অধ্যাপক ড. একে আজাদ চৌধুরী।
অনুষ্ঠানের শুরুতে স্বাগত বক্তব্য এবং অধ্যাপক তোফাজ্জল ইসলামের সংক্ষিপ্ত জীবনবৃত্তান্ত তুলে ধরেন বাংলাদেশ বিজ্ঞান একাডেমীর সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. হাসিনা খান।
একাডেমী লেকচারে কৃষি বিজ্ঞানী অধ্যাপক ড.তোফাজ্জল ইসলাম তাঁর দীর্ঘ ২৭ বছরের গবেষণায় প্রকৃতিতে উদ্ভিদ এবং অণুজীবের মিথস্ক্রিয়ার মলিকুলার কৌশল সম্পর্কিত আবিস্কৃত নতুন জ্ঞান এবং এসব জ্ঞানের ব্যবহারে উদ্ভিদের স্বাস্হ্য সুরক্ষার জীবপ্রযুক্তি তুলে ধরেন। মৌলিক গবেষণার মাধ্যমে অর্জিত নতুন জ্ঞানের প্রয়োগে কৃষির টেকসই উন্নয়নের জন্য অগ্রসরমান জীবপ্রযুক্তি উদ্ভাবনের বিশ্বব্যাপী ধারা নিয়ে আলোকপাত করেন। তিনি উদ্ভিদের সবচেয়ে মারাত্মক ছত্রাক-সদৃশ ওওমাইসিটি রোগজীবাণু কীভাবে পোষক উদ্ভিদের শিকড় নিসৃত রাসায়নিক সংকেতকে ব্যবহার করে পোষক উদ্ভিদকে শনাক্ত করে সংক্রমণ করে তা তাঁর নিজের আবিস্কার সবিস্তার তুলে ধরেন। মৌলিক গবেষণায় তাঁর আবিস্কৃত নতুন জ্ঞানের ব্যবহারে উদ্ভিদ রোগের টেকসই ব্যবস্থাপনার জীবপ্রযুক্তি বর্ণনা করেন।
একাডেমি লেকচারে তিনি ২০১৬ সালে দেশের দক্ষিনাঞ্চলের ৮ জেলায় গমে ব্লাস্ট রোগ মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়লে ১৫ হাজার হেক্টর জমির ফসল নষ্টের ভয়াবহতা বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, গমের ব্লাস্ট রোগের কারণে দেশের দরিদ্র কৃষকেরা শত শত কোটি কোটি টাকার ক্ষতির সম্মুখীন হয়। দেশের কৃষির সেই সংকটকালে চার মহাদেশের একদল গবেষককে একত্রিত করে তিনি কীভাবে কোন প্রকল্প বরাদ্দ ব্যতিরেকে মুক্ত তথ্য ও বিজ্ঞান চর্চার মাধ্যমে মাত্র তিন মাসের মধ্যে জীবনরহস্য বিশ্লেষণপূর্বক গমের ব্লাস্ট রোগের জীবাণুর উৎপত্তিস্থল নির্ণয়ের রোমান্সকর অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেন। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের বিজ্ঞানীদের সহায়তায় জিনোমিক এবং অত্যাধুনিক ক্রিস্পার-কাস-এ প্রযুক্তি ব্যবহারে দ্রুততম সময়ে অল্প খরচে গমের ব্লাস্ট রোগের জীবাণু সনাক্ত করার পদ্ধতি আবিস্কারের অভিজ্ঞতাও তুলে ধরেন। তাঁর আবিস্কৃত এ প্রযুক্তিটি কীভাবে বিশ্বব্যাপী কোয়ারিন্টাইন অফিসে ব্যবহার করে গমের মারাত্মক রোগটি অন্য কোন দেশে ছড়ানো প্রতিরোধ করতে পারে তা তুলে ধরেন। জিন এডিটিং এবং জিন স্থানান্তরের মাধ্যমে গমের ব্লাস্টরোগ প্রতিরোধী জাত উদ্ভাবনে তাঁর গবেষণার অগ্রগতি তিনি উপস্থাপন করেন।
অধ্যাপক ইসলাম প্রোবায়োটিক ব্যাকটেরিয়া প্রয়োগে গমের ব্লাস্টরোগ দমন এবং ধান উত্পাদনে সার সাশ্রয়ী বায়োফার্টিলাইজার প্রযুক্তি উদ্ভাবনের সাফল্য তুলে ধরেন। এছাড়া তাঁর নেতৃত্বে ভেষজ উদ্ভিদ ও বিভিন্ন অণুজীব থেকে এর্পযন্ত ৫০টির অধিক প্রাকৃতিক যৌগ বা এন্টিবায়োটিক আবিষ্কৃারের তথ্যাদিও তুলে ধরেন।
অধ্যাপক ড. তোফাজ্জল ইসলাম বলেন, টেকসই কৃষির উন্নয়ন ও নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনের যে অভীষ্ট লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে, সেটি অর্জন করতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়-ইন্ড্রাস্ট্রি যৌথভাবে কাজ করতে হবে। তারা যদি গবেষণায় উদ্ভাবিত নতুন জ্ঞান-ভিত্তিক প্রযুক্তি গুলো বাণিজ্যিকীকরণের উদ্যোগ নেয়, তাহলে সহজেই কৃষকেরা এই সুবিধা পেতে পারে। এতে যারা গবেষক আছেন তারা যেমন গবেষণায় উৎসাহ পাবেন, তেমনি দেশের অর্থনীতি ও কৃষিতে নতুন বিপ্লব সাধিত হবে।
তিনি আরও বলেন, যারা ভালো মানের গবেষণা করে এবং নতুন নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন করছে তাদের উদ্ভাবিত প্রযুক্তি গুলো মাঠ পর্যায়ে ছড়িয়ে দিতে সরকার ও ইন্ড্রাস্ট্রিজ গুলো এগিয়ে আসতে হবে। তাহলে গবেষণায় আমাদের যে মূল লক্ষ্য রয়েছে, তা দ্রুত বাস্তবায়নের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতি গতিশীল হবে।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে অধ্যাপক ড. একে আজাদ চৌধুরী বলেন, দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে মৌলিক গবেষণার বিকল্প নেই। নতুন জ্ঞান নতুন প্রযুক্তির কাঁচামাল। অধ্যাপক তোফাজ্জল ইসলাম বিশ্বজ্ঞান ভাণ্ডারে যে অবদান রেখেছেন এবং দেশের সমস্যা সমাধানের জন্য গবেষণায় যেসব সাফল্য দেখিয়েছেন তা অসামান্য এবং অনুকরনীয়। দেশের প্রতিভাবান এই গবেষকের আবিস্কারসমূহের ব্যবহারিক প্রয়োগে উদ্যোগ গ্রহণ জরুরী।
অধ্যাপক ইসলামের লেকচার উপস্থাপনের পর আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন বিশিষ্ট বিজ্ঞানী অধ্যাপক জিয়াউদ্দীন, অধ্যাপক হাসিনা খাঁন, ড. হামিদ মিয়া, ড. আব্দুল লতিফ, অস্টেলিয় বিজ্ঞানী আহমেদ আজাদ প্রমুখ। বিজ্ঞান একাডেমীর ফেলো অধ্যাপক তোফাজ্জল হোসেনের বায়োফার্টিলাইজার এবং বায়োপেস্টিসাইড হিসেবে ব্যবহার উপযোগী প্রোবায়োটিক ব্যাকটেরিয়ার একটি তালিকা বিজ্ঞান একাডেমীকে প্রদান করতে বলা হয়। এসব মূল্যবান জীবপ্রযুক্তিকে ব্যবহারিক প্রয়োগের জন্য বিজ্ঞান একাডেমী পরবর্তী গবেষণায় বিষয়টি বিবেচনা করবে বলে জানানো হয়।
সমাপনী বক্তব্যে বিশিষ্ট বিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. জহুরুল করিম বলেন, অধ্যাপক তোফাজ্জল ইসলাম কে আন্তরিক ধন্যবাদ ও অভিনন্দন জানাই অত্যন্ত চমৎকারভাবে স্বল্প সময়ের ভিতরে তাঁর গবেষণা কর্মকান্ডের গুরুত্বপূর্ণ দিক গুলো তুলে ধরার জন্য। দেশ এবং জাতিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে মৌলিক গবেষণার কোন বিকল্প নেই। আমাদের আরও বেশি বেশি গবেষণা করতে হবে এবং নিত্য নতুন যে সমস্যা গুলোর মুখোমুখি আমরা হচ্ছি, তা সমাধানে কার্যকরী ভূমিকা পালন করতে হবে। তিনি অধ্যাপক তোফাজ্জলকে দেশের নার্সভুক্ত গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সাথে কোলাবোরেশনের মাধ্যমে কাজ করার পরামর্শ দেন। ব্রিটিশ রয়াল সোসাইটির ফেলাসহ বিশ্ববিখ্যাত বিক্জ্ঞানীদের সাথে যৌথভাবে দেশের সমস্যাভিত্তিক গবেষণায় সাফল্য অর্জনের জন্য ভূয়শী প্রশংসা করেন এবং তাঁর আরও সাফল্য কামনা করেন।
ভার্চুয়ালি অনুষ্ঠিত উক্ত একাডেমি লেকচারটিতে বাংলাদেশ ও বিশ্ব বিজ্ঞান একাডেমীর ফেলো, দেশ ও বিদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের শতাধিক অধ্যাপক ও বিজ্ঞানী অংশগ্রহণ করেন।।