হাবিপ্রবি, দিনাজপুর: দিনাজপুরের হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (হাবিপ্রবি) মাননীয় ভাইস চ্যান্সেলর হিসেবে যোগদান করেছেন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ-গবেষক, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন রসায়নবিদ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের সভাপতি প্রফেসর ড. মো. এনামউল্যা।
সোমবার (২১ অক্টোবর, ২০২৪ খ্রি.) রাষ্ট্রপতি ও হাবিপ্রবি’র চ্যান্সেলর এর আদেশক্রমে ০৪ বছরের জন্য তাঁকে নিয়োগ প্রদান করা হয়। সকাল ৮.৫০ ঘটিকায় হাবিপ্রবি’র ক্যাম্পাসে পৌছালে শিক্ষার্থী, শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীবৃন্দ এক আনন্দঘন পরিবেশে তাঁকে বরণ করে নেন। যোগদানের প্রক্রিয়া শেষ করে ভিআইপি কনফারেন্স কক্ষে বিভিন্ন অনুষদের সম্মানিত ডীনবৃন্দ, পরিচালকবৃন্দ, রেজিস্ট্রার, হল সুপার, সিনিয়র শিক্ষক, প্রক্টর, কর্মকর্তা-কর্মচারী ও সাংবাদিকবৃন্দের সাথে পরিচিতি ও মতবিনিময় করেন।
উক্ত মতবিনিময় সভায় সভাপতিত্ব করেন হাবিপ্রবি’র সদ্য বিদায়ী জরুরি প্রশাসনিক ও আর্থিক দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রফেসর ড. হাসান ফুয়াদ এল তাজ। রেজিস্ট্রার প্রফেসর ড. এম. জাহাঙ্গীর কবির এর সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানের শুরুতেই পবিত্র কুরআন ও গীতা থেকে পাঠ করা হয় এবং সকল শহীদগণের স্মরণে দাঁড়িয়ে এক মিনিট নিরবতা পালন করা হয়। অত:পর শুভেচ্ছা বক্তব্যে ভাইস-চ্যান্সেলর বলেন, দেশের উত্তরাঞ্চলের মানুষের আশা-আকাক্সক্ষার প্রতীক রাষ্ট্রীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হাবিপ্রবি’র ভাইস-চ্যান্সেলর হিসেবে আমাকে নিয়োগদানের জন্য গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের মহামান্য রাস্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন, অর্ন্তবর্তীকালীন সরকারের মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা নোবেল জয়ী বিশ্বখ্যাত ক্ষুদ্র ঋণের প্রবক্তা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস, মাননীয় শিক্ষা ও পরিকল্পনা উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদসহ সংশ্লিষ্ট সকলকে আন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।
ভাইস-চ্যান্সেলর হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের প্রাক্কালে আমি গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি স্বৈরাচার ও ফ্যাসিস্ট সরকারের বিরুদ্ধে জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে যাঁরা শহিদ হয়েছেন। আমি গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি জুলাই-আগস্টের আন্দোলনে বেগম রোকেয়া বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী বীর শহিদ আবু সাঈদকে। উল্লিখিত আন্দোলনে দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রায় ২ হাজার ছাত্র-জনতা শহিদ হয়েছেন। প্রাণের মায়া ত্যাগ করে ফ্যাসিস্ট সরকারের বিরুদ্ধে যাঁরা হতাহত হয়েছেন-আমি সকলের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করছি। অকুতোভয় এই ছাত্র-জনতা আমাদের মাঝে পুর্নবার স্বাধীনতা, মুক্তি এবং প্রাণখুলে শান্তি-স্বস্তির নিঃশ্বাস নেয়ার পরিবেশ ফিরিয়ে এনেছেন। গণঅভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষক, পেশাজীবী, সাংবাদিক এবং খেটে খাওয়া নি¤œ আয়ের মানুষজনও ছিল। আমি সকলের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। লক্ষ কোটি ছাত্র-জনতার অংশগ্রহণে এবং অগণিত মানুষের আত্মদানে আমরা আজকে নতুন বাংলাদেশ পেয়েছি। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলন এবং ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে যাঁরা আত্মদান করে শহিদ হয়েছেন, আমি তাদের প্রতিও গভীর সম্মান জানাচ্ছি। স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশে বসবাস
করলেও আমরা বিগত বছরে ফ্যাসিস্ট সরকারের কাছে জিম্মি অবস্থায় কাটিয়েছি। ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে আমরা সেই জিম্মি অবস্থা থেকে মুক্ত হয়েছি। বৈষম্যমুক্ত ও ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্র কাঠামো গড়ে তোলার মাধ্যমে আমরা ছাত্র-জনতার তথা দেশের আপামর জনসাধারণের বহুল আকাক্সিক্ষত প্রত্যাশা পূরণ করতে পারি।
এই বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন অনুষদের অধীনে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক যুগোপযোগী বিভাগ রয়েছে। এই বিভাগগুলোর শিক্ষা-গবেষণার মান বৃদ্ধিসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক মান উন্নয়নে আমি দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করছি। হাবিপ্রবিকে বিশ্ব র্যাংকিং এ ভালো অবস্থানে নিয়ে যাওয়া এবং দেশসেরা হিসেবে আর্বিভূত করার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছি। এই লক্ষ্য বাস্তবায়নে অনেকগুলো কম্পোনেন্ট জড়িত। শিক্ষক-গবেষকগণের কার্যক্রম এসব কম্পোনেন্টের মূখ্য বিষয়। তাই আমি লক্ষ্য পূরণে শিক্ষক-গবেষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং সংশ্লিষ্ট সকলের সর্বাত্মক অংশগ্রহণ এবং সহযোগিতা প্রত্যাশা করছি। গবেষণায় আর্থিক বরাদ্দ ও প্রণোদনা অপরিহার্য। আমি এটা বৃদ্ধি করার উদ্যোগ নিব। আমার প্রশাসনে ন্যায্যতা, ন্যায়-নীতি অনুসরণ করা হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস-চ্যান্সেলর এর পদকে আমি ‘ক্ষমতা’ নয়, ‘দায়িত্ব’ মনে করি। ব্যক্তিগতভাবে আমি কোনো রাজনৈতিক দলের আদর্শ ধারণ করতে পারি। কিন্তু ভাইস-চ্যান্সেলর হিসেবে আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের সবার। আমি আপনাদের জানাতে চাই, ভাইস-চ্যান্সেলর হিসেবে দায়িত্ব পালনে আমি নিয়ম-নীতি, ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠা করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। ভিন্ন মতের উপর শ্রদ্ধা, পরমত সহিষ্ণুতা, পারস্পরিক সম্মান-শ্রদ্ধা গণতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য। এই বৈশিষ্ট্য আমি অক্ষুণœ রাখবো। দল-মত, ভিন্ন মতÑসকলের প্রতি ন্যায় ও যৌক্তিক আচরণ করবো।
প্রাপ্য অধিকার ও ন্যায্যতা থেকে কেউ বঞ্চিত হবেন না। শিক্ষার্থীরা যে সংস্কার এবং পরিবর্তনের অভিযাত্রা শুরু করেছেন, তাদের এই অভিযাত্রায় আমি অগ্রভাগে থাকবো। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা-গবেষণার পরিবেশ, রক্ষায় যা কিছু সম্ভব, আমি তা করবো।
২০২৪-এর জুলাই-আগস্টে বিপ্লবোত্তর একটি সরকার দায়িত্বে নিযুক্ত হয়েছে। স্যোশাল মিডিয়ার বর্তমান যুগে নানা বিষয়ে গুজবে ডালপালাও মেলছে। প্রতিবিপ্লবের আশংকার কথাও কেউ কেউ বলছে। আমি ছাত্র-শিক্ষক এবং জনসাধারণকে এ ব্যাপারে সজাগ ও সচেষ্ট থাকতে বলবো, যাতে প্রতিবিপ্লবের কুশীলবরা মাথা তুলতে না পারে। বৈষম্যমুক্ত-ন্যায়ভিত্তিক সমাজ ও দেশ গড়ার নেতৃত্ব আমাদেরকেই দিতে হবে।
আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে শহিদদের রক্ত এখনও শুকায়নি। বৈষম্য বিলোপ এবং সংস্কার ছিলো তাদের ব্রত। নতুন বাংলাদেশে বৈষম্য দূর, সংস্কার এবং ইতিবাচক পরিবর্তনের অঙ্গীকার আমাদের পূরণ করতেই হবে। আমি এ অঙ্গীকার পূরণে সকলের সহযোগিতা প্রত্যাশা করছি। পরিশেষে “উচ্চ শিক্ষার সার্বিক মান উন্নয়নে শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও সংশ্লিষ্ট সকলের মানসিকতার সংস্কার ও পরিবর্তন আশু প্রয়োজন।”
সভাপতির বক্তব্যে প্রফেসর ড. হাসান ফুয়াদ এল তাজ জুলাই বিপ্লবে যাঁদের রক্তের বিনিময়ে এ পরিবর্তন তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা ও তাদের পরিবারের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান। শিক্ষা ও গবেষণা ক্ষেত্রে যুগোপযোগী পরিবর্তনের মাধ্যমে হাবিপ্রবিকে উন্নত র্যাকিং এ নেওয়ার জন্য নবনিযুক্ত ভাইস-চ্যান্সেলর মহোদয়ের প্রতি আহŸান জানান। পাশাপাশি বিগত প্রশাসনের মাধ্যমে যে সকল শিক্ষার্থী, শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারী বৈষম্যের স্বীকার হয়েছেন তাদের ন্যায্য পাওনা প্রদানের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্যও তিনি আহবান জানান। মতবিনিময় শেষে মাননীয় ভাইস-চ্যান্সেলর মহোদয় হাবিপ্রবি’র কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে এ দেশের জন্য বিভিন্ন সময়ে আতœদানকারী মহান শহীদদের আত্মার প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে পুস্পস্তবক অর্পণ করেন।
উল্লেখ্য, মাননীয় ভাইস-চ্যান্সেলর প্রফেসর ড. মো. এনামউল্যা ভোলা জেলার পশ্চিম সৈয়দ আওলিয়ার একটি ছোট গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি নিজ গ্রামের মির্জাকালু উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়ার পর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগ থেকে বিএসসি ও এমএসসি ডিগ্রী অর্জন করেন। তিনি ১৯৯৪ সালে অষ্ট্রিয়ার ভিয়েনা টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি ডিগ্রী অর্জন করেন।
১৯৯৫ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন এবং ২০০৩ সালে অধ্যাপক হন (২০১৭ সালে সিলেকশন গ্রেড প্রফেসর)। ১৯৯৮-১৯৯৯ সালে জার্মানির হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে পোস্টডক্টরাল গবেষণার জন্য তিনি বিশ্ববিখ্যাত আলেকজান্ডার ভন হামবোল্ট ফাউন্ডেশন (এভিএইচ) ফেলোশিপ লাভ করেন।
২০০৩ সালে জাপানের টোকিও ডেনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনভায়ারমেন্টাল ম্যাটেরিয়ালস কেমিস্ট্রি বিভাগ ও আওয়ামা গেকুইন বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের ভিজিটিং অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এছাড়াও তিনি ২০১৫ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত কানাডার ইয়র্ক ইউনিভার্সিটি’র রসায়ন বিভাগে চুক্তিভিত্তিক ফ্যাকাল্টি হিসেবেও শিক্ষকতা করেছেন।
তিনি এবং তার গ্রæপ ইতিমধ্যে আমেরিকান কেমিক্যাল সোসাইটি, রয়্যাল সোসাইটি অব কেমিস্ট্রি, এলসেভিয়ার সায়েন্স, ইইউ-জার্নালস, উইলি-ভিসিএইচ, এমডিপিআই, টেলর অ্যান্ড ফ্রান্সিসসহ বিশ্বের স্বনামধন্য পেশাদার জার্নালে ১১৮ টি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছে। তিনি পৃথিবীর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে যৌথ গবেষণাকর্ম সম্পাদন করেন তৎমধ্যে ইউনিভার্সিটি অব দুসেলদর্ফ, জার্মানী, ইউনিভার্সিটি পিসা, ইটালি, ইউনিভার্সিটি অব ইয়র্ক এবং ইউনিভার্সিটি অব মেনিটোবা, কানাডা, ইউনিভার্সিটি অব জুরিখ, সুইজারল্যান্ড উল্লেখযোগ্য।
রসায়নে অগ্রগামী গবেষণার জন্য তাকে ২০১১ সালে “বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) পুরস্কার” প্রদান করা হয়। স¤প্রতি, তিনি জার্মানির আলেকজান্ডার ভন হামবোল্ট ফাউন্ডেশন (এভিএইচ) এর অধীনে অত্যন্ত মর্যাদাপ‚র্ণ “রিসার্চ গ্রুপ লিঙ্কেজ প্রোগ্রাম” পুরস্কার পেয়েছেন।
বর্তমানে, তিনি “বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন ফর কম্পিউটেশনাল অ্যান্ড ম্যাটেরিয়ালস সায়েন্স (বিএসিএমএস)”-এর সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এছাড়াও তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ^বিদ্যালয়ের সিনেট সদস্য, প্রভোস্ট, প্রক্টরসহ বিভিন্ন প্রশাসনিক পদে দায়িত্ব পালন করেছেন।
You must be logged in to post a comment.