নাম বদলের রাজনীতি বন্ধ হবে কবে ?

প্রকাশ:

Share post:

বার্তবুলেটিন ডেস্ক: আমি আইনজ্ঞ নই, আইনের জটিল মারপ্যাঁচও বুঝি না। তবে দেশের একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে আমি মনে করি জনগণই রাষ্ট্রের মালিক এবং জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস। কিন্তু ক্ষমতার পালা বদলে বিশ্বাসের সেই মূলভিত্তি যেন পরিবর্তন হতে থাকে। কেননা আমি দেখেছি, ক্ষমতার পালা বদলে “বদলে যায় নাম, বদলে যায় দেশের ইতিহাস”। রাষ্ট্র পরিচালনায় যখন যে দল ক্ষমতায় আসে তখন সেই দল তাঁর মত করেই সংস্কারের কাজ শুরু করে। বাংলাদেশে যেকোনো সরকার নতুন করে ক্ষমতায় আসলে শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি রক্ষার বদলে নিজেদের ক্ষমতার জানান দিতে ‘দলীয় বিবেচনায় বিভিন্ন স্থাপনা ও জায়গার নতুন নামকরণে সিদ্ধহস্ত হয়ে পড়ে। একই সাথে বিরোধী মত ও পথের মানুষকে আইনবহির্ভূতভাবে শুধুমাত্র মব জাস্টিসের মাধ্যমে হয়রানি ও লাঞ্ছিত করতে খড়গহস্ত হয়ে পড়ে। অথচ মানুষ প্রত্যাশা করে রাজনৈতিক দলগুলো জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে সংসদে গিয়ে জনআকাঙ্খার প্রতিফল ঘটাবে।

২০০১ সালের নির্বাচনে দুই তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর পিরোজপুরের ‘ইন্দুরকানি’র নাম পরিবর্তন করে জিয়ানগর এবং ‘বঙ্গবন্ধু সেতু’র নাম বদলে যমুনা সেতু নাম দেয়। একইভাবে কক্সবাজার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্ক ও বন্য প্রাণী প্রজনন কেন্দ্রের নাম ডুলাহাজারা সাফারি পার্ক, বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রের নাম পরিবর্তন করে বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্র করে।

বঙ্গবন্ধ, শেখ হাসিনাসহ ১৫আগস্টে নিহত শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিব, শেখ রাসেল, শেখ কামাল, শেখ জামাল, শেখ নাসেরসহ কয়েকজনের নামে করা প্রতিষ্ঠান ও স্থাপনা থেকেও তাদের নাম বাদ দেওয়া হয়। সুলতানা কামাল মহিলা ক্রীড়া কমপ্লেক্সের নাম পরিবর্তন করে ধানমন্ডি মহিলা ক্রীড়া কমপ্লেক্স, শেখ কামাল স্টেডিয়ামের নাম পরিবর্তন করে গোপালগঞ্জ স্টেডিয়াম করা হয়।

একদিকে যেমন বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের নাম পরিবর্তন করা হয়েছে অন্যদিকে বিএনপি, জামায়াতের আমলে জাতীয় জাদুঘরের প্রধান মিলনায়তনের নাম শহীদ জিয়া মিলনায়তন, চন্দ্রিমা উদ্যানের নাম পরিবর্তন করে জিয়া উদ্যান, শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের নাম পরিবর্তন করে বেগম খালেদা জিয়া মেডিকেল কলেজ ও শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল, কক্সবাজার জাগীরঘোনা মসজিদ সড়কের নাম বেগম খালেদা জিয়া সড়ক, ফেনী ফুলগাজী মহিলা কলেজের নাম বেগম খালেদা জিয়া মহিলা কলেজ করা হয়।

আরও পড়ুন:  ফুলবাড়ীতে আইনগত সহায়তা দিবস-২০২৫ পালিত

এমনকি বঙ্গবন্ধুর নামে প্রথম স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠকারী এম এ হান্নানের নামে করা চট্টগ্রাম আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এম এ হান্নানের নাম বাদ দিয়ে এর নামকরণ করে শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। ওই সময় জাতীয় চার নেতাসহ মুক্তিযুদ্ধের অগ্রসৈনিক ও ভাষাশহীদদের নামে করা প্রতিষ্ঠান ও স্থাপনা থেকেও তাদের নাম বাদ দেয় বিএনপি, জামায়াতের নেতৃত্বাধীন সরকার।

অন্যদিকে বিএনপি, জামায়াত সরকারের চোখের কাঁটা হলেও তাদের দেখানো পথেই হেঁটেছে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার। তারাও ক্ষমতায় এসে এ রকম শতাধিক প্রতিষ্ঠান, স্থাপনা, যান ও সরঞ্জামের নাম পরিবর্তন করেছে। সব ক’টির আগের নাম পুনর্বহাল করেছে। একই উদ্দেশ্যে জিয়ানগরের নাম পরিবর্তন করে করা হয় ইন্দুরকানি। জিয়া উদ্যান থেকে চন্দ্রিমা উদ্যান। পিজি হাসপাতাল থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর, বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রসহ বিভিন্ন স্থাপনাই নিজ পরিবারের লোকজনের নামে করা হয়। নাম বদলে আওয়ামী লীগের সরকার যুক্তি ছিলো ‘অবৈধ স্বৈরশাসকদের নামে কোনো স্থাপনা বা প্রতিষ্ঠানের নাম থাকা উচিত নয়’ আদালতের এমন রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন স্থাপনা থেকে তারা জিয়ার নাম মুছে ফেলার চেষ্টা করে। সেই একই কারণে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট স্বৈরাচার হাসিনা সরকারের পতনের পর বিভিন্ন স্থাপনার নাম পরিবর্তনের চেষ্টা চলছে। অবশ্য দেশে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে বিভিন্ন স্থান কিংবা স্থাপনার নাম পরিবর্তনের ঘটনা এটাই প্রথম নয়। বিগত স্বৈরাচার এরশাদ সরকার কিংবা বঙ্গবন্ধুর শাসনামলেও নাম পরিবর্তনের রাজনীতি বেশ সরব ছিলো।

এ প্রসঙ্গে একদা মওদুদ আহমদ বলেছিলেন, ‘জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নাম পরিবর্তন করায় জিয়া বা বিএনপির কোনো ক্ষতি হবে না। ক্ষতি হবে বর্তমান সরকারের। কারণ, এর মাধ্যমে বর্তমান সরকার কী পরিমাণ প্রতিহিংসাপরায়ণ, তা প্রকাশ করেছে। সুতরাং দুই সরকারের রেষারেষিতে সাধারণ মানুষের ট্যাক্সের টাকার অপচয়টুকু ছাড়া কাজের কাজ আর কিছুই হয়নি! তাঁর এই বক্তব্যের প্রেক্ষিতে এখন সেই একই কথা বলা যায়, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর স্থান/স্থাপনা/প্রতিষ্ঠানের নাম পরিবর্তন দেশের মানুষের কোন কল্যাণে আসবে না। তবে স্বৈরশাসকদের ইতিহাস মুছতে যদি নাম পরিবর্তন করতে হয় তবে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে নয় বরং ইতিহাস, ঐতিহ্য শিল্প সংস্কৃতিকে সামনে রেখেই এমন নামে নাম পরিবর্তন করুন যা সর্বজন গ্রহণযোগ্য। শুধু নাম পরিবর্তনই নয় সাথে আইনগত পদক্ষেপ নিন যেন কোন রাজনৈতিক দল তাঁদের পরিবারের বা নিজের নামে স্থাপনার নাম করতে না পারে। ক্ষমতার পালা বদল হলেও যেন নাম নিয়ে আর কেউ রাজনীতি করতে না পারে। কারণ নাম পরিবর্তনের প্রতিহিংসামূলক এই খেলায় দেশের অর্থনৈতিক অপচয়ের পাশাপাশি ইতিহাস কলুষিত হয়। যা নতুন প্রজন্মকে ভুল পথে পরিচালিত করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।

আরও পড়ুন:  জন্মদিনে সবুজ বন্ধুদের ভালোবাসায় সিক্ত আলমগীর কবির

পৃথিবীর বিভিন্ন বিভিন্ন দেশে শিল্প, সংস্কৃতির প্রচার ও প্রসার এবং দেশ মাতৃকার জন্য অবদান রাখা ব্যক্তিদের নামে বিভিন্ন জায়গা ও স্থাপনার নামকরণ হয়ে থাকে। অথচ বাংলাদেশে শুধু রাজনৈতিক কারণে এমন লোকের নামেও নামকরণ হয় যাদের সর্বজনীন গ্রহণযোগ্যতা বা দেশমাতৃকার জন্য কোনো অবদান নেই। তাই সরকারের উচিত সুশাসন ও কল্যাণমূলক কাজের মাধ্যমে নিজের ভাবমূর্তি জনসাধারণের কাছে অক্ষুণ্ন রাখতে নাম বদলের রাজনীতি বন্ধ করা। কারণ শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও ভালো কাজের মাধ্যমে দেশ মাতৃকাকে উন্নতির শিখরে নিয়ে বিশ্বের দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড় করাতে না পারলে শুধু নামে কী আসে যায়?</p

spot_img

সংবাদ সারাদেশ

ফুলবাড়ীতে আইনগত সহায়তা দিবস-২০২৫ পালিত

ফুলবাড়ী (কুড়িগ্রাম) প্রতিনিধি: কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ীতে দ্বন্দ্বে কোন আনন্দ নাই, আপোষ করো ভাই, লিগ্যাল এইড আছে পাশে, কোন চিন্তা...

ফিটনেস পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করাসহ গ্রীন ভয়েসের ৭ দাবি

পরিবেশ সুরক্ষায় পুরনো যানবাহনের ব্যবহার বন্ধ করা ও কালো ধোঁয়া নির্গমন ঠেকাতে ফিটনেস পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করাসহ ৭ দফা...

জানাক ও বৈষম্যবিরোধীর নেতৃত্বে আসছে নতুন রাজনৈতিক দল

জাতীয় নাগরিক কমিটি ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলনের নেতাদের নেতৃত্বে আসছে নতুন একটি রাজনৈতিক দল। আগামী ২৬ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদ...

কুয়েট উপাচার্যকে লাঞ্ছিত করার ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় পরিষদের নিন্দা

খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুয়েট) উপাচার্যকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করার ঘটনায় তীব্র প্রতিবাদ ও নিন্দা জানিয়েছেন দেশের পাবলিক...

Discover more from bartabulletin.com

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading