মহান স্বাধীনতাযুদ্ধে আত্মোৎস্বর্গকারী এক মুক্তিযোদ্ধার গল্প

প্রকাশ:

Share post:

এম আব্দুল মান্নান: বাঙালির সুদীর্ঘ রাজনৈতিক ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ ঘটনা ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামের এক ঐতিহাসিক ঘটনার মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতির কয়েক হাজার বছরের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বপ্ন সাধ পূরণ হয়। এ মাসেই স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি তাদের এ দেশীয় দোসর রাজাকার, আলবদর, আল-শামসদের সহযোগিতায় হানাদার গোষ্ঠী দেশের মেধাবী, শ্রেষ্ঠ সন্তান-বুদ্ধিজীবী হত্যার নৃশংস হত্যাযজ্ঞে মেতে উঠেছিল। সেই নরপিশাচ পাক হানাদার বাহিনীর শোষণ-নিপীড়ন থেকে দেশকে শত্রুমুক্ত করতে গিয়ে লাখ লাখ মুক্তিকামী মানুষ নিজের জীবনকে উৎসর্গ করেছেন। তাদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে আমাদের এই স্বাধীনতা। লাল-সবুজের আজকের এই বাংলাদেশ। মহান স্বাধীনতাযুদ্ধে আত্মোৎসর্গকারী এমনই এক অকুতোভয় বীর শহীদ আ.ন.ম নজিব উদ্দিন খান খুররম।

শহীদ খুররমের রক্তে রঞ্জিত হয়েছে এদেশের মাটি। যিনি দেশ মাতৃকার জন্য জীবন দিয়ে দেশের মাটি ও মানুষের প্রতি তার ভালোবাসা প্রমাণ করেছেন। দেশের জন্য জীবন উৎসর্গকারী এই অকুতোভয় বীর ১৯৫৩ সালে নরসিংদীর বেলাব উপজেলার হোসেন নগর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতার নাম আলাউদ্দিন খান। যিনি তৎকালীন পাকিস্তান জোন বোর্ডের পরিচালক ছিলেন। চার ভাই ও তিন বোনের মধ্যে খুররম ছিলেন চতুর্থ। ছোটবেলা থেকেই তিনি ছিলেন অত্যন্ত বুদ্ধিমান ও মেধাবী। পড়াশোনায় তো ভালো ছিলেনই; ছিলেন সমসাময়িক বিষয়ে সজাগ এবং সচেতন। যা তাকে আলাদা বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল করে তুলেছিল সমবয়সী অন্যদের থেকে।

১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে সমগ্র দেশ যখন উত্তাল হয়ে ওঠে তখন নজিব উদ্দিন খান খুররম ছিলেন ঐতিহ্যবাহী ঢাকা কলেজের ছাত্র। ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ঢাকা শহরের বিভিন্ন স্থানে হামলা চালালে তাদের নৃশংস হামলায় সেদিন অনেকেই মৃত্যুবরণ করেন। ওই দিন রাতে খুররম ঢাকা কলেজের ছাদে লুকিয়ে সেই নারকীয় হত্যাযজ্ঞ প্রত্যক্ষ করছিলেন। যা তাকে ভীষণভাবে মর্মাহত করেছিল। এরপর তিনি ঢাকা কলেজের সীমানা থেকে বের হয়ে পড়েন। শহরের অন্যান্য স্থানে তখনও কেবল লাশ। চারপাশে দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে চিরচেনা সব ভবন আর মহামূল্যবান স্থাপনায়। এসব দেখে মানসিকভাবে কিছুটা বিপর্যস্ত হয়ে পড়লেও প্রিয় মাতৃভূমিকে শত্রুমুক্ত করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন খুররম।

আরও পড়ুন:  হাবিপ্রবিতে 'বি' ইউনিটের গুচ্ছভর্তি পরীক্ষা সম্পন্ন: সি ইউনিটের পরীক্ষা ১ নভেম্বর 

খুররম ঢাকা থেকে বাড়ি ফিরে দেশকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বর্বরতা থেকে দেশকে মুক্ত করতে বন্ধুবান্ধব, এলাকার সমবয়সী এবং সহোদর ভাই এনায়েত উদ্দিন মো. কায়সার খানের সঙ্গে সলাপরামর্শ করেন। যেই ভাবনা, সেই কাজ। ছোট ভাই এনায়েতউদ্দিন মো. কায়সার খানকে সঙ্গে নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে নানার বাড়ি ভৈরবে চলে যান এবং সেখানেই তৎকালীন ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ক্যাপ্টেন নাসিমের নেতৃত্বে ভৈরবের কে.ভি স্কুল মাঠে রেজিমেন্ট দলের সৈনিকদের সঙ্গে প্রশিক্ষণে অংশ নেন। সেখানেই ভাগ্যক্রমে মামাতো ভাই বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমানের সাক্ষাৎ পান। এরপর ১২ এপ্রিল ক্যাপ্টেন নাসিমের নেতৃত্বে আশুগঞ্জ স্টেশনের দিকে অগ্রসরমান পাকবাহিনীর সৈন্যদের প্রতিহত করতে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট দলের সদস্যদের সঙ্গে ভৈরব ব্রিজ পার হয়ে তৎকালীন আশুগঞ্জ পাট গুদামে আশ্রয়ে নেন (রেল স্টেশনের পাশে)। আর সেখানেই প্রথম অস্ত্র হাতে পান খুররমসহ মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা। এভাবেই ঘটনার কথা বর্ণনা করেন খুররমের সহোদর বীর মুক্তিযোদ্ধা এনায়েতউদ্দিন মো. কায়সার খান।

তিনি বলেন, ১৫ এপ্রিল ভোরের আলো প্রস্ফুটিত হওয়ার আগেই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী স্যাবর জেট বিমান দিয়ে আমাদের লক্ষ্য করে আক্রমণ চালাতে থাকে এবং সেই সঙ্গে ভারী অস্ত্রধারী সেনাদের হেলিকপ্টারে করে নামিয়ে দেয়। তখন ক্যাপ্টেন নাসিমের নেতৃত্বে পাকসেনাদের সঙ্গে আমাদের তুমুল যুদ্ধ বেঁধে যায়। যুদ্ধের এক পর্যায়ে চোখে গুলি লাগে আমাদের এক সহযোদ্ধার। তাকে নিয়ে আমি নদীর পাড় ঘেঁষে হেঁটে হেঁটে পাশের একটি গ্রামে গিয়ে উঠি। এর এক পর্যায়ে পাক বিমানবাহিনীর সদস্যরা চারদিক থেকে আমাদের উপর আক্রমণ শুরু করে। সে সময় আমাদের কাছে বিমান ভূপাতিত করার মতো কোন অস্ত্র না থাকায় কৌশলগত কারণেই ক্যাপ্টেন নাসিম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট দলের সৈনিক এবং যুদ্ধরত মুক্তিবাহিনীর সদস্যদের নিয়ে পশ্চাৎপদ করেন। ততক্ষণে হানাদার বাহিনীর নিক্ষিপ্ত বোমা ও বুলেটে খুররমসহ মুক্তিবাহিনীর অনেকেই শাহাদত বরণ করেন।

কায়সার খান আরও বলেন, পৃথিবীর ইতিহাসে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের অভ্যুদয় একটি বিস্ময়কর এবং ব্যতিক্রমী ঘটনা। যার পেছনে রয়েছে দীর্ঘ রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম আর ত্যাগের ইতিহাস। স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র পেয়ে একজন শহীদের পরিবার হিসেবে আমরা গর্ববোধ করি। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দুর্নীতি, শোষণ-,নিপীড়ন মুক্ত অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের গড়ার যে স্বপ্ন দেখেছিলেন স্বাধীনতার অর্ধ-শতাব্দীকাল পেরিয়েও বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সেই সোনার বাংলাদেশ না হওয়ার দুঃখবোধ রয়েছে। তবে জাতির জনকের সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ এবং দূরদর্শী নেতৃত্বে বাংলাদেশ ঘুরে দাঁড়িয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর সুদক্ষ নেতৃত্বেই বাংলাদেশ এখন আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে উন্নয়নের রোল মডেল। উন্নয়নের এই ধারা অব্যাহত রাখতে সকলকে এক হয়ে কাজ করতে হবে।

আরও পড়ুন:  এটিএন বাংলা উন্নয়নে বাংলাদেশ অ্যাওয়ার্ড পেলেন অধ্যাপক ড.তোফাজ্জল 

ঢাকা কলেজের এ শহীদ শিক্ষার্থীর নামে বাংলাদেশ সরকার একটি স্মারক ডাকটিকিট উন্মোচন করেন। এ শহীদের স্মৃতির সম্মানার্থে ঢাকা কলেজের একটি অডিটোরিয়ামের নামকরণও করা হয়। বড় ভাইয়ের স্মৃতির স্মরণে মুক্তিযোদ্ধা এনায়েত উদ্দীন মো. কায়সার খাঁন তার নিজ জেলার বেলাব উপজেলায় ২০১২ সালে ‘শহীদ মুক্তিযোদ্ধা নজিব উদ্দীন খাঁন কলেজ’ নামে একটি কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। এছাড়া বেলাব উপজেলার হোসেন নগর গ্রামে ‘শহীদ নজিব উদ্দিন খান ফাউন্ডেশন’ প্রতিষ্ঠা করা হয়। এই ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে প্রতিবছর গৃহহীনদের পুনর্বাসন, নারীদের আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে বিনামূল্যে সেলাই মেশিন প্রদানসহ গরিব মেধাবী শিক্ষার্থীদের শিক্ষা বৃত্তি প্রদান করা হয়।
উল্লেখ্য, ১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে ঢাকা কলেজের যারা হয়েছিলেন তাঁদের একজন নজিব উদ্দিন খান খুররম। অন্যরা হলেন-শহীদ নজরুল ইসলাম, শহীদ আবদুস সবুর শিকদার, শহীদ আলী আহসান, শহীদ নিজাম উদ্দিন আজাদ, শহীদ মোয়াজ্জেম হোসেন, শহীদ আজিজুল ইসলাম বাবুল, শহীদ এম এ কাইয়ুম।

মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হওয়া এই আটজন মুক্তিযোদ্ধাকে শ্রদ্ধায় জড়িয়ে রাখতে মূল ভবনের প্রবেশদ্বারের বাম পাশে দেয়ালে পাথরে খচিত স্মৃতিফলক রাখা আছে। শহীদদের প্রতি সম্মান ও তাদের স্মৃতি অমলিন রাখতে পর্যায়ক্রমে আবাসিক হলসমূহের নামও এই বীর শহীদদের নামে নামকরণ করা হবে বলেও জানিয়েছে কলেজ প্রশাসন

spot_img

সংবাদ সারাদেশ

ফিটনেস পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করাসহ গ্রীন ভয়েসের ৭ দাবি

পরিবেশ সুরক্ষায় পুরনো যানবাহনের ব্যবহার বন্ধ করা ও কালো ধোঁয়া নির্গমন ঠেকাতে ফিটনেস পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করাসহ ৭ দফা...

জানাক ও বৈষম্যবিরোধীর নেতৃত্বে আসছে নতুন রাজনৈতিক দল

জাতীয় নাগরিক কমিটি ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলনের নেতাদের নেতৃত্বে আসছে নতুন একটি রাজনৈতিক দল। আগামী ২৬ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদ...

কুয়েট উপাচার্যকে লাঞ্ছিত করার ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় পরিষদের নিন্দা

খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুয়েট) উপাচার্যকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করার ঘটনায় তীব্র প্রতিবাদ ও নিন্দা জানিয়েছেন দেশের পাবলিক...

ইটভাটায় কাজে গিয়ে নিখোঁজ সন্তানকে ফিরে পরিবারের সংবাদ সম্মেলন

মাদারীপুর প্রতিনিধি: গাজীপুরে একটি ইটভাটায় কাজ করতে গিয়ে নিখোঁজ হয় মাদারীপুরের কালকিনি উপজেলার আলীনগর ইউনিয়নের কোলচুরি গ্রামের ১৯...

Discover more from bartabulletin.com

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading