ফুলবাড়ীতে স্কুল শিক্ষক গড়ে তুলেছেন ‘বঙ্গভাষা লেখক জাদুঘর’

প্রকাশ:

Share post:

বিখ্যামান বিভিন্ন লেখক ও কবিদের বই, পুরোনো ম্যাগাজিন ও পত্রিকা সংগ্রহ করে বাড়ীর আঙিনায় ১০ শতাংশ জমির ওপর গড়ে তোলা হয়েছে ‘বঙ্গভাষা লেখক জাদুঘর’। এখানে সংরক্ষণ করা হয়েছে কবি ও লেখকদের ছবিসহ তার আত্ম জীবনী। এছাড়া ও আছে সাহিত্যিকদের লেখা দুর্লভ চিঠি।

কুড়িগ্রামের সীমান্তঘেষা ফুলবাড়ী উপজেলার বড়ভিটা ইউনিয়নের উত্তর বড়ভিটা গ্রামে বাড়ীর আঙিনায় এই সংগ্রহশালা গড়ে তুলেছেন স্কুলশিক্ষক ও কবিসাহিত্যিক এবং গীতিকার তৌহিদ-উল ইসলাম (৫৮)। তিনি পাশ্ববর্তী লালমনিরহাট জেলার লালমনিরহাট সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক হিসাবে কর্মরত। তিনি নিয়মিত নিজরই ভাওয়াইয়া ও আধুনিক গান লেখেন। সেই সাথে বাংলাদেশ বেতার ও বিটিভির তালিকাভুক্ত গীতিকারদের মধ্যে রয়েছে তার নাম।

‘বঙ্গভাষা লেখক জাদুঘর’ ছাড়াও এই স্কুলশিক্ষক নিজের জমিতে গড়ে তুলেছেন সৈয়দ শামসুল হক কালচারাল ক্লাব ও গীতিকার তৌহিদ-উল ইসলাম পাঠাগার।

তৌহিদ-উল ইসলাম জানান, ‘বঙ্গভাষা লেখক জাদুঘর’টি বাংলাদেশের দ্বিতীয় ‘লেখক জাদুঘর’। ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে এই জাদুঘরটি প্রতিষ্ঠা করেছেন। দেশের প্রথম লেখক জাদুঘর চালু হয় ২০১১ সালে বাংলা একাডেমির বর্ধমান হাউসে।

‘বঙ্গভাষা লেখক জাদুঘর’টিতে পাঁচটি গ্যালারি জুড়ে রয়েছে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের দুই থেকে আড়াই শতাধিক প্রয়াত কবি ও লেখকের তথ্য সম্বলিত ছবি। সেখানে রয়েছে বাংলা সাহিত্য ও চলচ্চিত্র সংক্রান্ত পুরোনো পত্র-পত্রিকা। সংরক্ষণ করা হয়েছে মোহাম্মদ আকরাম খাঁ সম্পাদিত ১৯৩৬ সালের মাসিক ‘মোহাম্মদী’ পত্রিকা। কালীশ মুখোপাধ্যায়ের ১৯৪৫ সালের ‘রূপ-মঞ্চ’ এবং শ্রী দিলীপ সেন গুপ্ত সম্পাদিত ১৯৫৫ সালের ‘সচিত্র ভারতী’ পত্রিকা। সিনেমার পত্রিকাও রয়েছে অনেক। ১৯৬০ সালের মার্চ সংখ্যা মাসিক ‘মৃদঙ্গ’। ক্ষিতীশ সরকার সম্পাদিত ১৯৬১ সালের ‘জলসা’ পত্রিকা আছে। আবু জাফর সম্পাদিত ১৯৬৩ সালের ‘সন্দেশ’ এবং গাজী শাহাবুদ্দিন আহমদ সম্পাদিত ১৯৬৮ সালের ‘সচিত্র সন্ধানী’ আছে এখানে। ১৯৫৯ সালের সাপ্তাহিক ‘পাকিস্তানী খবর’ এবং ১৯৫৯ সালের ‘পাক-সমাচার’ আছে এ জাদুঘরে। ধর্মীয় পত্রিকা মাসিক ‘নেয়ামত’ এবং ১৯৬১ সালের ‘সমকাল’ আছে এখানে। ১৯৬৬ সালের ‘পূবালী’ পত্রিকাসহ ‘বেগম’ পত্রিকার বেশ কিছু সংখ্যা আছে এখানে। ১৯৬৮ সালের বিমল মিত্র সম্পাদিত ‘কালি ও কলম’ পত্রিকা আছে। ১৯৬৮ সালের রবীন্দ্র ভারতী পত্রিকা, ১৯৬৯ সালের বিশ্বভারতী পত্রিকা এবং ১৯৭০ সালের কবীর চৌধুরী সম্পাদিত বাংলা একাডেমি পত্রিকা সংরক্ষণ করা হয়েছে এ জাদুঘরে।

আরও পড়ুন:  ফুলবাড়ীতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক কমিটি গঠন

বঙ্গভাষা লেখক জাদুঘর

রেডিও পাকিস্তানের পাক্ষিক পত্রিকা ‘এলান’ রয়েছে এখানে। ১৯৫১ সালে প্রকাশিত ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ রচিত ৭ম ও ৮ম শ্রেণির ব্যাকরণ পরিচয়। সুবলচন্দ্র মিত্র সম্পাদিত ১০০ বছরের পুরনো ‘সরল বাঙ্গালা অভিধান’। এ ছাড়াও আছে প্রায় একশ বছর আগে প্রকাশিত বেশ কয়েকটি বই। এখানে রয়েছে ১৫০ বছর আগে বঙ্কিম চন্দ্র সম্পাদিত পত্রিকা ‘বঙ্গদর্শন’ ১১০ বছর আগের প্রমথ চৌধুরী সম্পাদিত ‘সবুজপত্র’। এ জাদুঘরে রয়েছে মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর সাপ্তাহিক ‘হক-কথা’। এছাড়া এখানে আছে ১৯৬৫-১৯৭২ সালের বেশ কিছু দৈনিক পত্রিকা।

স্কুলশিক্ষক তৌহিদ-উল ইসলাম ২০২২ সালে ‘আইপিডিসি-প্রথম আলো প্রিয় শিক্ষক সম্মাননা’ পান। সম্মাননার সাথে পাওয়া দুই লাখ টাকায় শুরু করেন বঙ্গভাষা লেখক জাদুঘর নির্মাণকাজ। নিজের জমানো আরও কয়েক লাখ টাকা ব্যয় করে গড়ে তোলেন মনোমুগ্ধকর এই সংগ্রহশালা।

এর আগে নিজ খরচে ২০১১ সালে গীতিকার তৌহিদ-উল ইসলাম পাঠাগার ও ২০২১ সালে সৈয়দ শামসুল হক সাংস্কৃতিক ক্লাব প্রতিষ্ঠা করেন। পাঠাগারে রয়েছে ছয়-সাড়ে ছয় হাজার বই ও পত্র-পত্রিকা। তিনি ব্যক্তি উদ্যোগে ২০২১ সাল থেকে চালু করেছেন সৈয়দ শামসুল হক শিশুসাহিত্য পুরস্কার। পুরস্কার হিসেবে দেওয়া হচ্ছে ২০ হাজার টাকা। এ ছাড়া প্রতিবছর গুণীজনদের সম্বর্ধনা দেওয়া হয়।

লালমনিরহট থেকে আসা দর্শনার্থী বিশিষ্ট সাংবাদিক এস দিলীপ রায় ও সাংস্কৃতিক কর্মী মুহিন সরকার জানান, একেবারেই প্রত্যন্ত অঞ্চলে ‘বঙ্গভাষা লেখক জাদুঘর’ দেখে আমরা মুগ্ধ। গ্রাম পর্যায়ের এতো সুন্দর জাদুঘর যিনি প্রতিষ্ঠিা করেছেন তিনি প্রশংসার দাবিদার। তারা জানান,’এখানে এসে আমরা বাংলা সাহিত্যের ব্যাপারে অনেক কিছু জানতে পেরেছেন। জাদুঘরটি ঘুরে দেখলে অনেক পুরনো ইতিহাস জানা যাবে।’

স্কুলশিক্ষার্থী পূজা রানী রায় বলেন, আমরা পাঠাগারে বই পড়তে আসলে চকলেট পাই। গ্রামের অনেক শিক্ষার্থী এই পাঠাগারে বই পড়ে সমৃদ্ধ হচ্ছে। আমরা এখান থেকে বই বাড়িতে নিয়ে যাই। বইপড়া শেষে পাঠাগারে বই ফেরত দেই। পুজা রাণী উল্লেখ করেন ‘আমি এই পাঠাগারের নিয়মিত পাঠক। এখানে আসলেই অনেক কিছু জানা যায়। তাই এই পাঠাগারের জ্ঞান অর্জন করার জন্যই মূলত আসা হয়। গ্রামে এতো সুন্দর পাঠাগার সত্যি আমি মুগ্ধ! জীবনে ভাবিনি এই প্রতিষ্ঠান আমাকে সেরা পাঠক হিসেবে এবছর পুরস্কৃত করবে। সত্যি নিজেই সৌভাগ্যবান মনে হচ্ছে।

আরও পড়ুন:  ফুলবাড়ীতে পুলিশের বিশেষ অভিযানে ৬ জুয়াড়ি আটক

স্থানীয় প্রধান শিক্ষক মিজানুর রহমান জানান, জাদুঘরে পুরাতন দুর্লভ পত্র-পত্রিকার মূল কপি সংরক্ষিত আছে। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ক্ষেত্রে এ জাদুঘরের ঐতিহাসিক মূল্য ও গুরুত্ব অপরিসীম। কালচারাল ক্লাবে গ্রামের লোকজন সমবেত হয়ে দেশীয় কালচার চর্চা করার সুযোগ পাচ্ছেন। গ্রাম পর্যায়ে জাদুঘরটি নির্মাণ করায় সবার নজর কাড়ছে। তিনি আরও জানান
জাদুঘর, পাঠাগার ও কালচারাল ক্লাব প্রতিষ্ঠা করতে জমি বিক্রি করেছেন স্কুলশিক্ষক তৌহিদ-উল ইসলাম। তার এক ছেলে পড়ছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সংগীত বিভাগে। এক মেয়ে একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী।

নাগেশ্বরী উপজেলার আশার আলো পাঠশালার চেয়ারম্যান ভ্রণ পিপাসু কুমার বিশ্বজিৎ জানান, স্কুলশিক্ষক কবিসাহিত্যিক ও গীতিকার তৌহিদ-উল ইসলাম স্যার নিঃসন্দেহে একজন ভালো মানুষ। সমাজ এরকম মানুষ খুবই কম হয়। তিনি প্রত্যন্ত অঞ্চলে জমি বিক্রি ও জমি দান করে বাড়ীর উঠানে ‘বঙ্গভাষা লেখক জাদুঘর’ পাঠাগার ও কালচারাল ক্লাব প্রতিষ্ঠা করে তিনি এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। বিশ্বজিৎ জানান,তিনি প্রতি মাসেই কমপক্ষে দুইবার এই জাদুঘরে আসেন।

তৌহিদ-উল ইসলামের স্ত্রী বেগম আমিনা সুলতানা বলেন, প্রথমদিকে স্বামীর এসব কাজ পাগলামি বলে মনে হয়েছিল। এখন মনে করছি আমার স্বামী সমাজ ও দেশের প্রতি দায়িত্ববান। সামাজিক কাজ করতে গিয়ে তিনি মাঝে মাঝে পরিবারের কথাই ভুলে যান। আমরা একসময় পৃথিবী ছেড়ে চলে যাবো কিন্তু আমার স্বামীর কাজ আমাদেরকে বাঁচিয়ে রাখবে।

স্কুলশিক্ষক কবিসাহিত্যিক ও গীতিকার তৌহিদ-উল ইসলাম বলেন, নিজের উপার্জনের অর্ধেক টাকা জাদুঘর, পাঠাগার ও কালচারাল ক্লাবের পেছনে ব্যয় হয়েছে। দুর্লভ লেখা ও পত্রিকা সংগ্রহ করতে টাকা খরচ করতে হয়েছে। আমার গড়ে তোলা জাদুঘর, পাঠাগার ও কালচারাল ক্লাব জাতি গঠনে ভূমিকা রাখবে। এটাই হবে আমার পরম শান্তি।

spot_img

সংবাদ সারাদেশ

ফুলবাড়ীতে আইনগত সহায়তা দিবস-২০২৫ পালিত

ফুলবাড়ী (কুড়িগ্রাম) প্রতিনিধি: কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ীতে দ্বন্দ্বে কোন আনন্দ নাই, আপোষ করো ভাই, লিগ্যাল এইড আছে পাশে, কোন চিন্তা...

ফিটনেস পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করাসহ গ্রীন ভয়েসের ৭ দাবি

পরিবেশ সুরক্ষায় পুরনো যানবাহনের ব্যবহার বন্ধ করা ও কালো ধোঁয়া নির্গমন ঠেকাতে ফিটনেস পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করাসহ ৭ দফা...

জানাক ও বৈষম্যবিরোধীর নেতৃত্বে আসছে নতুন রাজনৈতিক দল

জাতীয় নাগরিক কমিটি ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলনের নেতাদের নেতৃত্বে আসছে নতুন একটি রাজনৈতিক দল। আগামী ২৬ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদ...

কুয়েট উপাচার্যকে লাঞ্ছিত করার ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় পরিষদের নিন্দা

খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুয়েট) উপাচার্যকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করার ঘটনায় তীব্র প্রতিবাদ ও নিন্দা জানিয়েছেন দেশের পাবলিক...

Discover more from bartabulletin.com

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading